বঙ্গবন্ধুর ছেলে পরিচয় দেয়ার পরেই ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় শেখ কামালকে

বঙ্গবন্ধুর ছেলে পরিচয় দেয়ার পরেই স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালকে হত্যা করা হয়। মেজর (বহিস্কৃত) বজলুল হুদা প্রথমে শেখ কামালের পায়ে গুলি করে। পরে ব্রাশফায়ার করে হত্যা নিশ্চিত করা হয়।

আদালতে দেয়া বঙ্গবন্ধু বাড়ির অন্যতম পাহারাদার হাবিলদার কুদ্দুস সিকদারের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, বাড়িতে প্রথম ঢুকে বজলুল হুদা এবং  ক্যাপ্টেন (বহিস্কৃত) নূর চৌধুরী। সঙ্গে আরো কয়েকজন।

বঙ্গবন্ধুর ছেলে পরিচয় দেয়ার পরেই ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় শেখ কামালকে

Table of Contents

বঙ্গবন্ধুর ছেলে পরিচয় দেয়ার পরেই ব্রাশফায়ার করে হত্যাঃ বাড়িতে ঢুকেই বজলুল হুদা এবং  ক্যাপ্টেন (বহিস্কৃত) নূর চৌধুরী শেখ কামালকে দেখতে পায়। সাথে সাথে বজলুল হুদা স্টেনগান দিয়ে তাকে গুলি করে। শেখ কামাল বারান্দা থেকে ছিটকে গিয়ে অভ্যর্থনা কক্ষের মধ্যে পড়ে যান। সেখানে তাকে আবার গুলি করে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু ভবনের আবাসিক ব্যক্তিগত সহকারি এবং হত্যা মামলার বাদী মোহিতুল ইসলামের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যের মধ্যেও এ বর্ণনার কথা রয়েছে।

মোহিতুল ইসলাম ১৯৭২ সনের ১৩ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে সহকারী হিসাবে চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৭৫ সনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেসিডেন্টÑ পিএÑ কাম-রিসেপশনিস্ট ছিলেন। ১৪ আগস্ট দিবাগত রাত ৮টা থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত তার ডিউটি ছিল।

মোহিতুল ইসলাম তার সাক্ষ্যে শেখ কামালের হত্যা নিয়ে বলেন, ‘তথন ভোর সাড়ে চারটা- পাঁচটা হবে। চারদিক ফর্সা হয়ে গেছে । বাড়ির চারদিকে বৈদ্যুতিক আলোও জ¦লছিল। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে তখন গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ পর  গুলি বন্ধ হলে কাজের ছেলে আবদুল ওরফে সেলিম ওপর থেকে পাঞ্জাবি-চশমা এনে দিলে বঙ্গবন্ধু ওই পাঞ্জাবি চশমা পরে বারান্ধায় এসে ‘আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি এত গুলি হচ্ছে তোমরা কি কর’ বলে উপরে চলে যান।

তারপর শেখ কামাল ওপর থেকে এসে বলেন ‘আর্মি ও পুলিশ ভাই আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।’ তখন  তিনÑচারজন কালো খাকি পোশাকধারী সশস্ত্র আর্মি আসে। এর মধ্যে খাকি পোশাকধারী বজলুল হুদা শেখ কামালের পায়ে গুলি করে। শেখ কামাল তখন শেখ মুজিবের ছেলে পরিচয় দিলে সাথে সাখে শেখ কামালকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর ছেলে পরিচয় দেয়ার পরেই ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় শেখ কামালকে
বজলুল হুদা যে শেখ কামালকে হত্যা করেছিলেন তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পাওয়া যায় লেখক মহিউদ্দিন আহমদের ‘৩২ নম্বর পাশের বাড়ি -২৫ মার্চ ১৫ আগস্ট ’ গ্রন্থে। এতে বাতেন নামে একজনকে হুদা মুজিব হত্যার যে বিবরন দেন তাই উদ্ধৃত করা হয়েছে। বাতেন ছিলেন জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।

সেই সময় থাকতেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মহসীন হলে। ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের পর বজলুল হুদা তার বোনের বাসায় হাজির হয়ে বাতেনকে নিয়ে বের হয়। এর আগের দিন বাতেন তার বোনের বাসায় রাত কাটান। হুদা বাতেনকে নিয়ে গনভবনের পেছনে সেনা ক্যাম্পের একটি ক্যান্টিনে খাওয়া দাওয় করেন। হুদা সেখানে বাতেনকে মুজিব  এবং কামাল হত্যার বর্ণনা দিয়েছিলেন।

হুদার ভাষ্যমতে, ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে বহিস্কৃত মেজর নূরের নেতৃত্বে বজলুল হুদারা আক্রমণ চালান। গোলাগুলির শব্দ শুনে শেখ কামাল বেরিয়ে আসেন। হুদা তৎক্ষণাৎ তাকে গুলি করে হত্যা করে।

তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহকে বাড়ি আক্রমণের পর বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে যা বলেছিলেন তাতেও এর সত্যতা পাওয়া যায়। ১৯৮৭ এবং ১৯৯৩ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে দুটি সাক্ষাৎকারে শফিউল্লাহ বলেছেন, বাড়ি আক্রমণের পর বঙ্গবন্ধু জলদি ফোর্স পাঠানোর জন্য তাগিদ দিয়ে তাকে ফোন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে বোধ হয় মাইরা ফেলছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’

প্রবাসী লেখক ও গবেষক গোলাম মুরশিদ ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিষদ বিবরণ দিয়েছেন। শেখ কামাল নিহত হওয়ার পর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গীরা বাড়ির ভেতরে ঢুকে মুজিবকে খুঁজতে থাকে। শেষে তাঁর দেখা পায় সামনের বারান্দায়। সাহসের প্রতিমূর্তি মুজিব দাঁড়িয়ে আছেন প্রশান্তভাবেÑ হাতে পাইপ।

বঙ্গবন্ধুর ছেলে পরিচয় দেয়ার পরেই ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় শেখ কামালকে
তাঁকে দেখে খুনী মহিউদ্দিন পর্যন্ত ভড়কে যায়। বঙ্গবন্ধুকে গুলি করতে পারেনি। কেবল বলেÑ ‘স্যার, আপনে আসেন’। শেষে যখন তাঁকে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামাতে আরম্ভ করে তখন বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে বলেন, ‘তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?’ এ সময় মহিউদ্দিনকে এক পাশে সরতে বলে হুদা আর নূর স্টেনগান দিয়ে গুলি করে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর ওপর।

ভোর পাঁচটা চল্লি¬শে মুখ থুবড়ে বঙ্গবন্ধু লুটিয়ে পড়েন সিঁড়িতে। তখনো তাঁর ডান হাতে ধরা পাইপ। কয়েকটা গুলি তাঁর বুকের ডান দিকে এবং পেটে লেগেছিলো। ফলে, যখন সূর্য ওঠার কথা, সেই সূর্য ওঠার সময় বঙ্গের গৌরব-রবি গেলো অস্তাচলে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘাতকদের মিশন তখনো শেষ হয়নি। মহিউদ্দিন, হুদা ও নূর বাড়ির বাইরে চলে যাওয়ার পর ল্যান্সার আর আর্টিলারির সেনাদের নিয়ে আসে আজিজ পাশা আর মুসলেমউদ্দীন।

পাশা তার সঙ্গীদের নিয়ে দোতলায় যায়। আগে থেকেই সেখানে ছিল সুবেদার ওয়াহাব জোয়ারদার। তারা গিয়ে রাসেল, শেখ নাসের এবং বাড়ির এক ভৃত্যকে নিচে নিয়ে যায়। শোবার ঘরে গিয়ে বেগম মুজিব, শেখ জামাল এবং কামাল ও জামালের সদ্য বিবাহিত স্ত্রীদের স্টেনগানের গুলি দিয়ে হত্যা করে পাশা আর মুসলেম উদ্দীন।

বঙ্গবন্ধুর ছেলে পরিচয় দেয়ার পরেই ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় শেখ কামালকে
নিচে নিয়ে গিয়ে ঘাতকরা রাসেলকে প্রথমে বসিয়ে রেখেছিল গেইটের পাশে পাহারাদারের চৌকিতে। রাসেল তখন মায়ের কাছে যাবে বলে কাঁদছিল। পাশা একজন হাবিলদারকে তখন হুকুম দেয় রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যেতে। সেই হাবিলদার সত্যি সত্যিই তাকে মায়ের কাছে পাঠিয়েছিলো দোতলায় নিয়ে গিয়েÑএকেবারে কাছ থেকে গুলি করে।

আরও দেখুনঃ

Comments are closed.