স্বপ্নের পদ্মা সেতু : বরগুনায় উন্মোচিত হবে শিল্প উদ্যোগের নতুন দ্বার। রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরগুলোর সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ ও পরিবহন সুবিধা পেতে যাচ্ছে বরগুনা। এখানকার উৎপাদিত কাঁচামাল থেকে অন্য এলাকার শিল্প-কারখানাগুলোতে যে পণ্য তৈরী হয়, এখানেই শিল্প কারখানা গড়ে তুলে চাহিদা অনুযায়ী সে পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু : বরগুনায় উন্মোচিত হবে শিল্প উদ্যোগের নতুন দ্বার
সেই স্বপ্নও দেখছেন উদ্যোমী উদ্যোক্তরা। এমনটাই জানিয়েছেন বর্তমান জেলা পরিষদ প্রশাসক ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. দেলোয়ার হোসেন। উপকূলীয় এই জেলায় প্রচুর প্রাকৃতিক স¤পদ রয়েছে। রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আবাদি এবং অনাবাদি জমি, বনরাজি এবং পর্যটন কেন্দ্র সোনাকাটা, হরিণঘাটা। বঙ্গোপসাগর, পায়রা ও বিষখালী নদী, হাজারো খাল, জলাশয়, পুকুরের মৎস্য সম্পদে ভরপুর এই উপকূলীয় জেলাটি। এখানে বসবাস করে ঐতিহ্যবাহী রাখাইন সম্প্রদায়।
বর-গুনা জেলার ৬টি উপজেলায় বিভিন্ন ধরনের ছোট এবং মাঝারি শিল্প, কল-কারখানা গড়ে ওঠার উপযোগিতা রয়েছে। অভাব ছিলো শুধু অনুকূল যোগাযোগ ব্যবস্থার। পদ্মা সেতুর কল্যাণে যোগাযোগের যে সমস্যাটা ছিলো তা দূর হচ্ছে বলে আলাপকালে জানিয়েছেন উদ্যোগী মানুষেরা।
এখানে রয়েছে বিসিক শিল্প নগরীও। শিল্প উদ্যোক্তাদের আগ্রহী করতে ইতোমধ্যে বর-গুনার বিসিক শিল্প নগরীতে জমির দাম কমিয়েছে বিসিক কর্তৃপক্ষ।
বিসিক জেলা কার্যালয়, বর-গুনার উপ-ব্যবস্থাপক কাজী তোফাজ্জেল হক জানিয়েছেন, ভৌগলিক কারনে, দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে, স্থানীয়দের শিল্পজ্ঞান কম থাকায় এ জেলায় সম্ভাবনা থাকা স্বত্বেও আশানুরূপ শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেনি।
বিসিক কর্তৃপক্ষ আশা করছেন খুব দ্রুতই বর-গুনায় শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ও ভারসাম্যপূর্ণ আঞ্চলিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বর-গুনা শহরের ক্রোক এলাকায় বিসিক শিল্পনগরী কাজ শুরু হয় ২০১১ সালে।
এরপর ১৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। এ শিল্পনগরীর প্লট বরাদ্দের জন্য প্রথমে শতাংশ প্রতি ৩ লাখ দুই হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়।
পরে উদ্যোক্তাদের সুবিধা বিবেচনা করে দু’দফায় দাম কমিয়ে বর্তমানে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে শতাংশ প্রতি ২ লাখ টাকা করে।
উপ-ব্যবস্থাপক কাজী তোফাজ্জেল হক আরও জানান, বর-গুনার বিসিক শিল্পনগরীতে ৬০টি প্লট রয়েছে। এরমধ্যে ৬ হাজার স্কয়ার ফিটের এ ক্যাটাগরির প্লট রয়েছে ২৭টি, ৪৫ হাজার স্কয়ার ফিটের বি ক্যাটাগরির প্লট রয়েছে ২২ এবং সি ক্যাটাগরির প্লট রয়েছে ১১টি।
এর মধ্যে এ ক্যাটাগরির চারটি প্লট বিক্রি হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হলে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও শিল্পোদ্যোক্তারা এখানে আসবেন। শিল্পনগরীতে প্লট বরাদ্দ দেয়ার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বিসিক কর্তৃপক্ষ।
জেলাটি কৃষি নির্ভর হলেও এখানে রয়েছে ৫০ হাজারের বেশি পেশাজীবী জেলে। মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য আহরিত ও উৎপাদিত মাছ অন্য এলাকায় পাঠানো হতো।
এ জেলার পাথরঘাটায় একটি প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র থাকলেও আমতলী ও তালতলীতে প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র স্থাপন ও বরফকলের প্রয়োজনীয়তা বহু দিনের, জানিয়েছেন জেলে ও আড়তদাররা।
তালতলীর উপজেলা চেয়ারম্যান রেজবি উল হক জানান, তালতলী উপজেলার সাগর পাড়ের আশার চরে রয়েছে শুঁটকি পল্লী। শুঁটকিকে কেন্দ্র করে এখানে পোল্ট্রি ও ফিস ফিড শিল্প গড়ে উঠবে।
বর-গুনার পায়রা, বিশখালী নদী থেকে আহরণ করা হয় গলদা ও বাগদা রেনু পোনা। বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের চিংড়ি ঘেরগুলোতে রেনু পোনা রপ্তানী করা হয়।
চিংড়ির রেনু পোনা উৎপাদনের জন্য মৎস্য হ্যাচারী এবং বাণিজ্যিক চাষের জন্য ঘের শিল্প গড়ে তোলা খুবই সহজ, আলাপ কালে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ^জিত কুমার দেব।
কৃষি বিভাগের সূত্রগুলো জানিয়েছে, এ জেলার জলাভূমিগুলোতে প্রচুর পরিমাণে শামুক পাওয়া যায়। চুন তৈরীর উপকরণ ও মাছের খাদ্য হিসেবে সেগুলি চালান হয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। শামুককে কেন্দ্র করে কুটির বা ছোট শিল্প গড়ে তোলা স্বল্প বিনিয়োগের ব্যাপার।
স্থানীয় চাষীরা ধান, বাদাম, ডাল, মিষ্টি কুমড়ো, আলু, তরমুজ, বাঙ্গিসহ নানা জাতের ফসল উৎপাদন করে থাকে। কিন্তু সংরক্ষণের জন্য এখানে অদ্যাবদি কোন হিমাগার গড়ে ওঠেনি।
জেলা কৃষি বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক বদরুল হোসেন জানিয়েছেন, এখানকার জমিতে আউস, আমন, ইরি, বোরোসহ নানা জাতের ধান চাষ হয়ে থাকে।
স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পরে উৎপাদিত ধান দিনাজপুর, মুন্সিগঞ্জ, মদনগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জে চালান করা হয়। সেখানে যন্ত্রের মাধ্যমে সাধারণ ধান থেকে বাহারী নামের ও আকৃতির চালে রূপান্তর ঘটিয়ে কয়েকগুন বেশী দামে আবার এই অঞ্চলেই বিক্রি করা হচ্ছে।
ধানের প্রাচুয্যতার উপর ভিত্তি করে জেলার সকল উপজেলাতেই একাধিক করে আধুনিক রাইস মিল গড়ে উঠতে পারে।
বর-গুনার সদরের বালিয়াতলী এবং তালতলী উপজেলায় রয়েছে রাখাইন সম্প্রদায়ের বসবাস। এ দুুটি স্থানে রাখাইনদের নিজস্ব তাঁত শিল্প রয়েছে। তাদের প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
তালতলী, সোনাকাটা, আশারচর, ফকিরহাট, বর-গুনার বালিয়াতলী, বেতাগীর বিবিচিনি, পাথরঘাটার হরিণঘাটসহ বেশ কয়েকটি পর্যটন ষ্পটকে কেন্দ্র করেও পর্যটন শিল্পেরও অমিয় সম্ভাবনা রয়েছে।
বরগুনার সংসদ সদস্য অ্যাড. ধীরেন্দ্র দেবনাথ শমভু জানান, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরগুনার একটি আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বরগুনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়ন তার হাত ধরেই হচ্ছে।
বরিশাল থেকে ৬টি নদীর উপর সেতু করে তিনি সড়ক যোগাযোগের মসৃণতা এনেছেন। এবার পদ্মা সেতুর মাধ্যমে রাজধানী থেকে পটুয়াখালী ও বরগুনার সাগরপাড় পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করলেন।
সুষ্ঠু যোগাযোগ ও পরিবহন সুবিধার কারনে বরগুনায় শিল্প-কারখানা গড়ে উঠে এটি শিল্পোন্নত জেলায় পরিনত হবে বলে আশা করছি।”
আরও দেখুনঃ
Comments are closed.