প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি জীবন সম্পর্কে জানুন !

শেখ হাসিনার দিল্লি জীবন : ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে দেশের রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হন তিনি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার চার বছরেরও কম সময়ের মধ্যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল সদস্য সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির ৩২ এর নিজের বাসভবনে সপরিবারে হত্যা করা হয়।

পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শেখ হাসিনা copyright free image form daily-sun.com
পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শেখ হাসিনা

তবে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে প্রাণে বেঁচে যান শেখ মুজিবের পরিবারের দুই সদস্য, তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বাংলাদেশের ইতিহাসের লাল অক্ষরে রচিত সেই দিনে শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা ছিলেন বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে, রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসভবনে। সেখানে শেখ হাসিনার সঙ্গে আরো ছিলেন তার স্বামী ওয়াজেদ মিয়া এবং দুই শিশুসন্তান, সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।

বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের খবরটি বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের কাছে আসে পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বন থেকে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সানাউল হকের বাসায় ফোন দিয়ে জানান এই দুঃসহ সংবাদ। পরবর্তীতে ব্রাসেলস থেকে শেখ হাসিনারা চলে যান বনে রাষ্ট্রদূত চৌধুরীর বাসভবনে। সেখান থেকেই বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অন্যান্য রেডিও স্টেশন থেকে তারা নিশ্চিন হন বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে।

১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট থেকেই রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী শুরু করেন গোপন তৎপরতা; বঙ্গবন্ধুর দুই জীবিত কন্যাকে কোনো দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করিয়ে দেয়া যায় কি না। এ বিষয়টি দিল্লির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলে তারা বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে, এবং দুদিন পরই তারা বলে, শিগগিরই যেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দিল্লিতে পাঠানোর প্রস্তুতি নেয়া হয়।

ভারতীয় কর্মকর্তাদের তরফ থেকে আরো বলা হয়ে থাকে, গোটা বিষয়টি যেন খুব গোপনে করা হয় এবং দ্রুত সম্পন্ন করা হয়, এবং শেখ হাসিনাদেরকে যেন এয়ার ইন্ডিয়ার মাধ্যেমে প্লেনে সরাসরি দিল্লিতে পাঠানো হয়।

এভাবেই শেখ হাসিনারা ২৪ আগস্ট বিকেলের দিকে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেন, এবং ২৫ আগস্ট খুব ভোরে তারা দিল্লিতে পৌঁছান। এর মাধ্যমে শুরু হয় শেখ হাসিনার পৌনে ছয় বছরের দিল্লি জীবন।

শেখ হাসিনার দিল্লি জীবন – বাসস্থান :

শেখ হাসিনাদের প্রথমে রাখা হয় ৫৬ নম্বর রিং রোডের একটি ‘সেফ হাউজ’-এ। পরে তাদেরকে ডিফেন্স কলোনির একটি বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং তাদের প্রতি তিনটি পরামর্শ দেয়া হয়। প্রথমত, তারা যেন বাড়ির বাইরে কোন কিছু না যানে; দ্বিতীয়ত, তারা যেন সেখানে কারো কাছে নিজেদের কোন প্রকৃত পরিচয় না দেন; তৃতীয়, দিল্লিতেও যেন কারো সঙ্গে যোগাযোগ না রাখেন।

লন্ডনে শেখ রেহানার বাড়ি র সামনে শেখ হাসিনা Image Source: Prothom Alo
লন্ডনে শেখ রেহানার বাড়ি র সামনে শেখ হাসিনা

দশ দিন পরে, ৪ সেপ্টেম্বর ভারতের মধ্যে থাকা একজন সরকারি কর্মকর্তা শেখ হাসিনাদেরকে নিয়ে যান ইন্দিরা গান্ধীর সরকারি ভাবে থাকা বাসভবন, ১ সফদরজং রোড এর বাসায়। এরও আরো দশদিন পর তাদেরকে পান্ডারা পার্কের সি ব্লকের একটি ফ্ল্যাটে নেওয়া হয় তাদেরকে। ওই ফ্ল্যাটে তিনটি শোবার ঘর আর কিছু সংখ্যক আসবাব ছিল।

খবর দেখার জন্য একটি সাদা–কালো টেলিভিশন এর সেটও দেওয়া হয়। তখন ভারত এর টেলিভিশনে শুধু দুই ঘণ্টার জন্য দূরদর্শনের সময় অনুষ্ঠান প্রচারিত করা হতো। তবে সেই সময় তাদের বাড়ির মধ্যে কোনো টেলিফোন এর কোন সংযোগ দেওয়া হয়নি।

কড়া নিরাপত্তার জন্য বলয়ের মাঝে দিন কাটত তাদের। বাড়ির আশপাশে ছিল নিরাপত্তার কড়া বেষ্টনী বাহিনী। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কর্তাদের অনেক ভয় ছিল শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিয়ে। তাই নিরাপত্তা বাহিনীদের পাশাপাশি গোয়েন্দাদেরকেও নজরে থাকত হতো সেখানে।

শেখ হাসিনার দিল্লি জীবন – ওয়াজেদ মিয়ার চাকরি:

পশ্চিম জার্মানিতে শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়া কর্মরত ছিলেন একজন পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ভারতে নির্বাসনকালেও তিনি হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। নয়া দিল্লির অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে চাকরি নেন তিনি এবং ১৯৮২ সাল অবধি সেখানেই কাজ অব্যাহত রাখেন।

শেখ হাসিনার দিল্লি জীবন – সন্তানের পড়াশোনা:

শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ভারতেই কয়েকটি বোর্ডিং স্কুলে যান। এর মধ্যে ছিল তামিল নাড়ুর পালানি হিলসের কোদাইকানাল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং নৈনিতালের সেইন্ট জোসেফ’স কলেজ।ইউনিভার্সিটি অভ ব্যাঙ্গালোরে তিনি কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেন, এবং পরবর্তীতে ট্রান্সফার হয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের আর্লিংটনের মধ্যে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অভ টেক্সাসে।

শেখ হাসিনার দিল্লি জীবন – প্রণব মুখার্জির যখন অভিভাবক:

শেখ হাসিনারা যখন প্রথম দিল্লিতে পৌঁছলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রণব মুখার্জিকে বলেছিলেন, “আপনি এখন থেকে দিল্লিতে ওদের অভিভাবক।” বাস্তবিকই শেখ হাসিনাদের সত্যিকারের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন প্রণব মুখার্জি।

শেখ হাসিনা image source: সাম্প্রতিক দেশকাল
শেখ হাসিনা image source: সাম্প্রতিক দেশকাল

প্রণব মুখার্জি শেখ হাসিনাকে তার বড় মেয়ে বলে মনে করতেন। তার ছেলে অভিজিতের সঙ্গে হাসিনার ছেলে জয়ের এবং শেখ রেহানার সঙ্গে প্রণব মুখার্জির মেয়ে শর্মিষ্ঠার ভাল সম্পর্ক ছিল।

এদিকে শেখ হাসিনার সঙ্গেও দারুণ ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে প্রণব মুখার্জির স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জির। তাকে ‘বউদি’ বলে ডাকতেন শেখ হাসিনা। তিনি এতটাই হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল সেই সম্পর্ক যে, ২০১৫ সালে শুভ্রা মুখার্জি যখন মারা যান, তখন শেখ হাসিনা প্রটোকলে এর তোয়াক্কা না করে আবার দিল্লিতে চলে গিয়েছিলেন।

আর ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন প্রণব মুখার্জি। শেখ হাসিনা তাকে এতটাই শ্রদ্ধা করতেন যে, নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতে চাইতেন।

শেখ হাসিনার দিল্লি জীবন – মানসিক অবস্থা :

দিল্লি এর মধ্যে কাটানো পৌনে ছয় বছরের মধ্যে মানসিকভাবে শেখ হাসিনা ছিলেন অত্যন্ত বিপর্যস্ত অবস্থায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তার নিজের পরিবারের সিংহভাগ সদস্যেদের সঙ্গে যা হয়েছিল, সেটি তার পক্ষে মেনে নেয়া শেখ হাসিনার জন্য ছিল অত্যন্ত দুরূহ একটি ব্যাপার ছিলো। সেদিনের স্মৃতির বিভীষিকা এর মতো করে তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল তাকে।

শেখ হাসিনা copyright free image form wikibio
শেখ হাসিনা দেশে ফিরার পরের ছবি

এমনকি ১৫ আগস্টে এর ব্যাপারে বিন্দুমাত্র পরিমানেও উল্লেখও ছিল শেখ হাসিনার জন্য এটি একটি বড় ধরনের ট্রিগার। তাই তার স্বামী ওয়াজেদ মিয়া তার সাথে দেখা করতে আসা সকল মানুষদেরকে বিশেষভাবে অনুরোধ করতেন, তার সামনে যেন ১৫ আগস্ট এর বিষয়ক কোনো প্রকার কথাই তোলা না হয়।

শেখ হাসিনার দিল্লি জীবন – শেষ কথা :

শেখ হাসিনার দিল্লিতে কাটিয়েছেন পৌনে ছয় বছর এর এই ছয় বছরের বিশেষ গুরুত্ব হলো, ওই সময়টাকে তিনি ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছেন নিজের মন শক্ত করতে, এবং দেশে আবার ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরার সঠিক প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে।

১৯৭৫ সালে তিনি নিজের পরিবারের প্রায় সবাইকে হারানোর পরপরই বাংলাদেশের মধ্যে ফিরে আসতে পারলে শেখ হাসিনা আর কী করতেন, আর বাংলাদেশের ৭৫-পরবর্তী ইতিহাসই বা ঠিক কেমন হতো, তা আমাদের মধ্যে কারো কখনোই জানার সুযোগ হবে না।

তবে এটুকু বলাই যায় যে, ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি যে মানসিকভাবে শক্তিশালী ছিলেন ,তার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একজন ব্যক্তি হিসেবে নিজ স্বদেশ বাংলাদেশের প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, আর পরবর্তীতে ধরেছেন বাংলাদেশের হাল এবং সঠিক অবস্থা, সেই অধ্যায় এর ভিত রচিত হয় তার পৌনে ছয় বছরএর দিল্লি জীবনের মধ্যেই।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পূর্ণ জীবনী সম্পর্কে জানতে:

উইকিপিডিয়া: শেখ হাসিনা

আমাদের অন্যান্য আর্টিকেল:

Comments are closed.